Sandwip Thana

নদীর স্রোত ও সমুদ্রের গর্জনে হাজার বছর টিকে থাকা একটি প্রাচীন মানব বসতি দেশের বন্দর নগরী চট্টগ্রাম জেলার ১৫টি উপজেলার মধ্যে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম  একটি প্রশাসনিক জনপদ সন্দীপ উপজেলা। প্রাচীন ইতিহাসে লিপিবদ্ধ লবণ শিল্প, জাহাজ নির্মাণ ও বস্ত্র শিল্পের জন্য পৃথিবীখ্যাত সন্দ্বীপ নামটি শত শত বছর ধরে স্বগৌরবে মহিমাণ্বিত হয়ে আছে।

মেঘনার ললাটে সাগরের টিপ, দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপ। তিন সহস্রাধিক বছরের প্রাচীন এই দ্বীপের নাম করণের বিষয়ে অনেক কিংবদন্তি প্রচলিত থাকলেও সর্বাধিক গ্রহনযোগ্য মতটি হচ্ছে-আদিতে এটি ছিল চারিদিকে অথৈ জলরাশি পরিবেষ্টিত একটি বিশাল বালিরস্তুপ’যাকে ইউরোপীয়দের ভাষায় স্যান্ডহিপ বলে বলা হত। কালক্রমে এই ‘‘স্যান্ডহিপ’শব্দটি ‘‘সন্দ্বীপ’নামে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে সন্দ্বীপ ৭৬২.৪২ বর্গকিমিটার আয়তনের একটি উপজেলা ও থানা মানচিত্র।

আয়তনের বিচারে এটি চট্টগ্রাম জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম একটি উপজেলা ও নিম্ন জনঘনত্ব এলাকা। দ্বীপ সাদৃশ্য উপকূলীয় এ উপজেলার অর্থনীতি, মানুষের সামাজিক পরিবেশ ও অপরাধ প্রবণতার ধরন চট্টগ্রাম জেলার অন্যান্য থানা অঞ্চলের চেয়ে একটু ভিন্ন। কি সেই ভিন্নতা? চট্টগাম রেঞ্জ পুলিশের প্রধান অভিভাবক তথা চট্টগ্রাম রেঞ্জের ৬১তম উপ-মহাপরিদর্শক নুরেআলম মিনার নেতৃত্বে, জেলার পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ’র তত্বাবধানে কেমন চলছে চট্টগ্রাম জেলার উপকূলীয় এ সন্দ্বীপ প্রশাসনিক নগরের আইন শৃংখলা? অস্ত্র, মাদক উদ্ধার, চাঞ্চল্যকর মামলার রহস্য উদঘাটন ও আসামি গ্রেফতার কার্যক্রমে কতটুকু সফল সন্দ্বীপ থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ সহিদুল ইসলাম? এসব প্রশ্নের যথার্থ উত্তরসহ আজকের আয়জনে থাকছে সন্দীপের তিন হাজার বছরের লালিত ইতিহাস, ঐতিহ্যের মুগ্ধকর গল্পে সাজানো বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম বিভাগের প্রথম আয়োজন সবুজ সংকেত, সন্দ্বীপ।

 

 

চট্টগ্রাম জেলা সদর থেকে নৌপথে 26.99 নটিক্যাল মাইল দূরত্বে উত্তর-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্ব কোণে মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত দেশের অত্যান্ত প্রাচীন একটি দ্বীপপৃষ্ঠ সন্দীপ উপজেলা। প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি ‘সন্দ্বীপ’ এখন দেশের মানুষের কাছে স্বর্গদ্বীপ হিসেবে বিবেচিত। হিংস্র ঢেউ আর ভয়ংকর জলরাশির মধ্যে ভেসে থাকা এ সন্দ্বীপের সাথে মিশে আছে লক্ষ মানুষের জীবিকা আর জীবনের গল্প। সেই সাথে লিপিবদ্ধ হয়েছে সন্দ্বীপের প্রশাসনিক সীমানা পরিবর্তন ও শাসন রাজত্বের গল্প। সন্দ্বীপ কখনো আরাকান, কখনো পর্তুগীজ আবার কখনো বারো ভুইয়ার অন্তর্গত কেদার রায়ের অধীনে ছিলো। মুঘলদের আগে এখানে স্থায়ী কোনো শাসন কাঠামো গড়ে উঠেনি বা সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো ধারণাও পাওয়া যায় না। জানা যায়,  ১৭৭০ দশক পর্যন্ত ঢাকার প্রাদেশিক পরিষদের অধেনে ছিলো সন্দ্বীপ। ১৭৮০ সালের কৃষক বিদ্রোহ দমনের সুবিধার্থে এটি চট্টগ্রামের সাথে সংযুক্ত হয়। সে থেকে ১৮৮০ সালের পূর্ব পর্যন্ত সন্দ্বীপ চট্টগ্রামের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রশাসনিক সীমানা ছিলো কিন্তু পরবর্তী ৭৪ বছর অঞ্চলটি নোয়াখালী জেলার অন্তর্ভুক্ত থাকে। অতপর ১৯৫৪ সালে স্থানীয়দের দাবির মুখে একে আবারো চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তৎকালীন যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী এডভোকেট মোজাম্মেল হোসেনের বিজয়ের মাধ্যমে সন্দীপ থানাকে চট্টগ্রামের সাথে সংযুক্ত করা হলে সেই থেকে সন্দ্বীপ এখনো চট্টগ্রাম জেলার একটি গর্বিত প্রশাসনিক এলাকা হিসেবেই দেশের মানচিত্রে পরিচিত হয়ে আছে। উল্লেখ্য, সন্দীপ থানাকে ১৯৮৪ সালে উপজেলায় রুপান্তর করা হয় এবং ১৯৯৯ সালের ২৮ ফেব্রয়ারী উপজেলা সদরকে ঘিরে সর্বমোট ২৩টি মৌজা নিয়ে ৩০.০৩ বর্গ কি.মি. সীমানাকে সন্দ্বীপ পৌরসভা ঘোষনা করা হয়। বর্তমানে সন্দ্বীপ উপজেলা ১টি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। গত শতকের গোড়ার দিকে সন্দীপ দ্বীপের ভূ-পৃষ্ঠ আরও বিস্তৃত ছিলো। কিন্তু নদী ভাঙ্গনে আজ বহু জনবসতি এলাকা বিলুপ্ত হয়েছে। সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়েছে পাঁচটি ইউনিয়ন যেগুলো যথাক্রমে হুদ্রাখালী, কাটগড়, ইজ্জতপুর, নয়ামস্তি ও বাটাজোড়া ইউনিয়ন নামে আসীন ছিল যার এখন কোন অস্তিত্ব নেই। এবং দীর্ঘাপাড় নামের ইউনিয়নটি মেঘনা নদীর ভাঙ্গনের ফলে অস্তিত্বের লড়াইয়ে কিঞ্চিৎ অংশ এখনো টিকে আছে। যা একটি গ্রামের চেয়েও ছোট জনপদ। বিলুপ্তপ্রায় এই এলাকাটি এখন ইউনিয়ন হিসেবে পরিগন্য নয়। সন্দ্বীপ উপজেলার বর্তমান ইউনিয়নগুলো হলো ১) রহমতপুর ২) হরিশপুর ৩) কালাপানিয়া ৪) আমানউল্যা ৫) সন্তোষপুর ৬) গাছুয়া ৭) বাউরিয়া ৮) হারামিয়া ৯) মগধরা ১০) মাইটভাঙ্গা ১১) সারিকাইত ১২) মুছাপুর ১৩) আজিমপুর ও ১৪) উড়িরচর ইউনিয়ন।

 

সন্দ্বীপ নামের এ দ্বীপের অনেক কিছুই আজ নেই। নদীর করালগ্রাসের পরও এখনো বেশ সমৃদ্ধির পসরা সাজিয়েছে সন্দ্বীপ। ম্যানগ্রোভের দৃষ্টিনন্দন বেষ্টনি, বিশাল সবুজ চর, ঐতিহাসিক শুকনা দিঘী, গুপ্তছড়া ঘাটের বিশাল জেটি রাস্তাসহ সবুজের অসংখ্য পটে আঁকা দৃশ্য। দৃষ্টি জুড়ে সবুজ আর সবুজ, অসংখ্য পাখির কলতান, মিষ্টি বাতাস, সুবিশাল নীল আকাশ আর মাটির টান। ভালো লাগার এক অনন্য দৃশ্যপট তুলে ধরবে সবার দৃষ্টিজুড়ে। ইচ্ছে হবে খোলা আকাশের নিচে প্রকৃতির সাথে মিতালি বেঁধে সবুজ স্নানে স্বপ্ন আঁকতে। প্রকৃতির এই অপরূপ স্নীগ্ধে বাসবাস করছে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষাধিক মানুষ। তাদের কেউ কৃষক, কেউ শ্রমিক, কেউ ব্যবসায়ী আবার কেউবা জেলে। নদী ও সমুদ্র ঘেরা। এখানকার বর্তমান অর্থনীতি প্রধানত মৎস্য চাষ ও আহরণ এবং ধান চাষের উপর নির্ভরশীল। এছাড়াও প্রবাসী রেমিটেন্স একটি বড় ভুমিকা পালন করছে সন্দ্বীপের অর্থনীতিতে। বাংলাদেশের মোট বৈদাশিক মুদ্রা আয়ের প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশ যোগান দিচ্ছেন এই দ্বীপে জন্ম নেওয়া প্রবাসীরা। সন্দ্বীপে যেমনি রয়েছে নৈসর্গিক রুপ, তেমনি রয়েছে নদী, পুকুর, ও বিলে দেশীয় বিভিন্ন জাতের সুস্বাদু মাছের ছড়াছড়ি। এছাড়া এখানে গরু-মহিষের দুধ, দই ও শীতকালে প্রচুর খেজুরের রস পাওয়া যায়। সন্দ্বীপ শিবের হাটের বিনয় সাহা’র মিষ্টির সুনাম বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে আছে। নানা জাতের পাখি, নারকেল গাছ আর মৌসুমি ফলের গাছে ভরা বাগানসহ রয়েছে রয়েছে নানারকম শাক-সবজি ফসলের ক্ষেত ও আকাশ চুম্বী  সরু সুপারী গাছের বাগান। যার অপূর্ব বেষ্টনী দর্শনার্থীর মন কেড়ে নেয়। এখানে শীতকালে অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠে। জেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে পাখিরাও মাছ শিকার করে। দলবেঁধে পাখিদের উড়াউড়ি মন কেড়ে নেয়। সন্দ্বীপে এককালে কম খরচে মজবুত ও সুন্দর জাহাজ নির্মানের জন্য পৃথিবীখ্যাত ছিল। ইউরোপের বিভিন্ন এলাকায় এই জাহাজ রপ্তানি করা হতো। ভারতবর্ষের মধ্যে সন্দ্বীপ ছিল একটি সমৃদ্ধশালী বন্দর। তাছাড়া একসময় এই সন্দীপ ছিলো উপমহাদের শ্রেষ্ঠ লবন বাণিজ্যকেন্দ্র। ১৭৭৬ সালের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রতি বছর সন্দ্বীপে উৎপাদিত প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার মণ লবণ, তিনশ জাহাজে করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হত। এছাড়াও এখানকার বস্ত্রশিল্পের সুনাম ছিলো গোট বিশ্বজুড়ে। আজ সেসব গৌরবাণ্নিত বাণিজ্যিক অতিত অতীতের মতই বহু দূরে। তবে যে অতীত কখনোই ভুলবে বাঙ্গালী জাতি তা হলো ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সন্দ্বীপ থেকে বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফার প্রচারণা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করেছিলেন। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধেও রয়েছে পাকহানাদার কর্তৃক সন্দীপের লোমহর্শক ইতিহাস। যার পরিসমাপ্তি ঘটে নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে ৭ ডিসেম্বর সন্দীপকে শত্রুমুক্ত ঘোষনা করার মাধ্যমে।

স্বাধীন বাংলাদেশের আজকের সন্দীপ শস্য সম্পদ ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্টে আপন প্রাচুর্যে পূর্ণ। যার রূপে মুগ্ধ হয়ে যুগে যুগে অনেক কবি সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক পর্যটকগণ এসেছেন এখানে। ১৫৬৫ সালে ডেনিশ পর্যটক সিজার প্রেডরিক সন্দ্বীপে আসেন এবং এর বহু প্রাচীন নিদর্শনের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন। ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দের ২৮ শে জানুয়ারি মোজাফ্ফর আহম্মদের সাথে সন্দ্বীপে আসেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সন্দ্বীপে ভ্রমণের সময়কার স্মৃতির পটভূমিতেই কাজী নজরুল ইসলাম তার মধুবালা গীতিনাট্য রচনা করেছিলেন। সন্দ্বীপে বৃক্ষের ছায়াতলে বসে নজরুল তার চক্রবাক কাব্য গ্রন্থের অনেকগুলো কবিতা রচনা করেন। প্রায় ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ১৫ কিলোমিটার প্রশস্ত সন্দ্বীপ উপজেলার ভূ-খন্ডের অবারিত সবুজ মাঠ, শতবর্শী প্রাণহরি গুহ, নদীর বুকে জেগে উঠা চর, শিল্প, গহীন চরে কৃষান-কৃষাণীর ফসল উত্তেলন, ধুধু বালুময় চরে ভেড়া চরে বেড়ানো, স্টিমার ঘাটের পাশে অবস্থিত জাহাজ ভাঙ্গা, কুমিরা নৌ টার্মিনাল, সমুদ্রপাড়ে গড়ে ওঠা ছোট ছোট পর্যটন ছাউনি আর জেলে মৎসজীবীদের দূরন্ত গতির কর্মযজ্ঞ দেখতে মন ভরে উঠবে আগত পর্যটকদের। তাছাড়া এশিয়ার সবচেয়ে ব্যয়বহুল সোলার প্যানেল ‘পুরবী’ এই দ্বীপেই অবস্থিত।

অতিথি পরায়ণের দিক দিয়ে সন্দীপের রয়েছে আলাদা সুনাম। বলা হয়ে থাকে যে, অচেনা পথিক খাবার পানি চাইলে,  ডাবের পানি দিয়ে ঐ পথিকের বা পর্যটকের তৃষ্ণা মিটিয়েছেন এই দ্বীপের মানুষ। প্রাকৃতিকভাবে দুর্যোগ কবলিত সন্দ্বীপ। ইতিহাস, ঐতিহ্যে ও সৌন্দর্যে অপরূপ এ সন্দ্বীপ জন্ম দিয়েছে মাদ্রাসায়ে দেওবন্দে মাওলানা আজিউল্লাহর মতো মেধাবী আলেম, কমরেড মুজফফর আহমদের মতো বিশ্বখ্যাত রাজনীতিবিদ, ভাষা সৈনিক রাজকুমার চক্রবর্তীর মতো দক্ষ পার্লামেন্টেরিয়ান ও শিক্ষাবিদ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামী আবু তোরাব চৌধুরীর মতো বীর যোদ্ধা, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাহসী সৈনিক ও চিকিৎসা শাস্ত্রের কৃতী ছাত্র লালমোহন সেন, মাওলানা খান বাহাদুর জিয়াউল হক, অবিভক্ত বাংলার প্রথম গ্র্যাজুয়েট মৌলভী বছির উদ্দীনসহ অসংখ্য গর্বিত সন্তান। ছোট্ট একটি ভূ-খন্ডে এতোজন বীর কৃতী সন্তানের সমাবেশ ইতিহাসে সত্তিই বিরল।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।