Raozan Thana

রাউজান, শব্দটি মূলত রজোওয়াং শব্দের অপভ্রংশ।  যার অর্থ রাজ পরিবারের ভূমি। এককালে এই অংশ আরাকানীদের অধীকারে ছিলো। সেকালের চট্টগ্রাম অঞ্চলকে লোকজন ঠাট্টা বিদ্রুপ করে মগের মুল্লুক বলে সম্মোধন করতো। এ ইতিহাস আনুমানিক ৬শতাব্দীর গোরার দিকের। এর বহুকাল পরে ১৭ শতাব্দীর মধ্যভাগে মোগল সুবেদার শায়েস্তা খাঁন কর্তৃক চট্টগ্রাম বিজয়ের পর রাউজান নামটি প্রথমবারের মত মৌখিকভাবে স্বীকৃতি পায় এবং ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের সময় রাউজান নামে একটি পুলিশ স্টেশন বা থানা গঠিত হয়। অতঃপর  বাংলাদেশ স্বাধীনতালাভ পরবর্তী ১৯৮৪ সালে  রাউজান থানাকে একটি মান উন্নিত থানায় রুপান্তর করা হয় তথা রাউজান নামটি উপজেলা মানচিত্রে যাত্রা শুরু করে।  এরপর দীর্ঘ ১৬ বছরে রাউজান শহরের দাপ্তরিক উন্নয়ন বৃদ্ধি পাওয়ায় শহরের গুরুত্ব বিবেচনা করে ২০০০ সালে রাউজান উপজেলার আওতাধীন সাবেক ৫নং সুলতানপুর ইউনিয়নের সম্পূর্ণ অংশ ও ৪নং গহিরা ইউনিয়নের কিছু অংশ নিয়ে ২৭.১৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনে রাউজান পৌরসভা গঠিত হয়।

আজ থেকে ৭৬ বছর পূর্বে গঠিত রাউজান থানা আজ পরিচয় পেয়েছে রাউজান মডেল থানা হিসেবে। অবকাঠামোর পাশাপাশি বদলে গিয়েছে রাউজানের অর্থনীতি, সামাজিক জীবন ধারা ও প্রশাসনিক আইন শৃঙ্খলার মান। বদলে গেছে থানার সেবা, পুলিশের আচরণগত বৈশিষ্ট্য ও পুলিশের প্রতি মানুষের অস্পষ্ট ধারনাগুলো। বিশেষ করে চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের প্রধান সম্মানিত ডিআইজি নুরেআলম মিনার যোগদানের পর থেকে তার গৃহীত  সময় উপযোগী বিবিধ কার্যকরি পদক্ষেপ চট্টগ্রাম রেঞ্জের প্রতিটি থানাকে আলোর রুপে পরিচিত করেছে।

চট্টগ্রাম জেলার মান্যবর পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ ডিআইজি নুরেআলম মিনার প্রতিটি উদ্যোগকে শতভাগ কার্যকর করতে থানার প্রতিটি অফিসারকে খুবই গুরুত্বের সাথে কাজ করতে নির্দেশনা দেন, সে নির্দেশনার আলোকেই সকল কার্যক্রম পরিচালনা করছেন রাউজান থানার অফিসার ইনচার্জ আবদুল্লাহ আল হারুন।

 

 

চট্টগ্রাম জেলা সদর থেকে  প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত রাউজান উপজেলার উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে  ফটিকছড়ি উপজেলা, পশ্চিমে হালদা নদী ও হাটহাজারী উপজেলা, দক্ষিণ-পশ্চিমে হালদা নদী ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের চান্দগাঁও থানা, দক্ষিণে কর্ণফুলী নদী ও বোয়ালখালী উপজেলা এবং পূর্বে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা ও রাঙ্গামাটি জেলার কাউখালী উপজেলা। ভৌগোলিক দিক থেকে রাউজান নিজ জেলার ৫টি ও পার্শ্ববর্তী ১টি প্রশাসনিক অঞ্চলের মধ্যবর্তী চট্টগ্রাম জেলার বিশেষ জনপদ। আয়তনের দিক থেকে রাউজান চট্টগ্রাম জেলার ৯ম বৃহত্তম উপজেলা। যার মোট আয়তন ২৪৬.৫৯ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যার দিকেও ৯ম স্থান দখল করেছে রাউজান। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ সংখ্যা মোট ৩,২৫,৩৮৯ জন। সম্পূর্ণ উপজেলা সীমানা মোট ১৫টি উপপ্রশাসনিক কাঠামোতে বিভক্ত। যা ১টি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়ন এলাকায় গঠিত।

 

রাউজান উপজেলাকে বলা হয় চট্টগ্রামের শিক্ষা নগরী। এ উপজেলাতেই রয়েছে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।এটি বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সরকারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। চট্টগ্রাম শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে রাউজান শহরের উপকন্ঠে ১৬৯ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত এ শিক্ষাঙ্গনটির কারনে রাউজানের নাম দেশ জুড়ে বিস্তৃত। যা উপজেলাকে চট্টগ্রামের কাছে আলাদা মর্যাদায় দাখিল করেছে। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও ৩ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজসহ অন্যান্য আরও ১০টি কলেজ রয়েছে রাউজান উপজেলা সীমানাতে। তাছাড়া অন্যান্য আরও প্রায় ২ শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুনামধন্য প্রশাসনিক অঞ্চল এই রাউজান উপজেলা

৬৬ শতাংশ শিক্ষার হারের রাউজানের অর্থনীতির প্রধান উৎস কৃষি। রাউজানের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে প্রচুর মরিচ জন্মে। এখানকার মরিচের আকার, রং ও স্বাদে খুবই অতুলনীয়। মরিচ ছাড়াও ধনিয়া, পিঁয়াজ, বাদাম, আখ, তরমুজ, শসা, সরিষা, কলাই, ফেলন প্রভৃতি উৎপাদিত হয়।  রাউজান কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে হলদিয়া ও পাহাড়তলী এলাকার পাহাড়ে আদা, রসুন, পিঁঁয়াজ, হলুদ, তেজপাতা, দারুচিনি, কলা, নারিকেল, আনারস, সুপারী, জলপাই ইত্যাদির চাষ করা হচ্ছে। এছাড়াও রাবার চাষের ক্ষেত্রে রাউজান বাংলাদেশের অন্যতম উপজেলা। রাউজানের হলদিয়া, ডাবুয়া, ঢালার মুখ এলাকায় প্রচুর রাবার বাগান রয়েছে।

উল্লেখ্য যে, রাউজান উপজেলার দক্ষিণ পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কর্ণফুলি নদী ও পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত ঐতিহাসিক হালদা নদী। এ নদীকে ঘিরে ঐতিহাসিক কাল থেকেই হাজার হাজার মানুষের জীবন জীবিকা জড়িত ছিলো। হালদার মুখে ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মদুনাঘাট জিয়া বাজারে প্রচুর উৎপন্ন হতো। সেই সাথে লবন ব্যবসার জন্য এলাকাটি খুবই প্রসিদ্ধ ছিলো। এখনো সেই আদি পেশা এ জনপদে চলমান আছে তবে তা খুবই স্বল্প পরিসরে। বর্তমানে রাউজানের উপর দিয়ে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় অর্থনীতির চাকা আরও গতি পেয়েছে।

রাউজান উপজেলার প্রাচীন ইতিহাসের সাথে বৌদ্ধ উপনিবেশের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাউজানে আদি বসতি স্থাপনকারী হলো বৌদ্ধরা। যার বহু নিদর্শন এখন সুস্পষ্টভাবেই সাক্ষ্য দেয়। উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে রয়েছে একাধিক বৌদ্ধ বিহার। তন্মধ্যে বন্দে পুরুষোত্তম সৎসঙ্গ বিহার, আবুরখীল বৌদ্ধ বিহার, চুলামনি বৌদ্ধ বিহার, আবুরখীল বৌদ্ধ বিহার ও মহামুনি বৌদ্ধবিহার রাউজান উপজেলার বৌদ্ধদের বিশেষ স্থান হিসেবে পরিচিত। তাছাড়া যুগে যুগে যারা এ রাউজান শাসন করেছিলেন তাদের নিদর্শন হিসেবেও রয়েছে রামধন ও যদুনাথ চৌধুরী নামে দুটি জমিদার বাড়ি।

রাউজানের প্রকৃতি উপভোগের জন্য রয়েছে হালদা নদীর পাড়, ঐতিহাসিক লস্কর উজির দীঘি, কচুখাইন মাঝের চর ও অনেকগুলো রাবার বাগান। এছাড়াও রয়েছে কৈলাসেশ্বর শিবমন্দির ও শিবমূর্তি, কুন্ডেশ্বরী ভবন, জগন্নাথ দেবালয় ও তোড়ন, সাহেব বিবি মসজিদআশরাফ শাহ (রহ.) মাজার

রাউজান উপজেলার রয়েছে  বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক এক নির্মম ইতিহাস। লুটপাট ও ব্যাপক অগ্নিসংযোগ সহ একদিনে প্রায় ৫০জন নিরীহ বাঙ্গালীকে হত্যা করেছিলো হানাদার বাহীনি। সেদিনের মরণমন যুদ্ধে রাউজানস্থ চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের (বর্তমানে চুয়েট) সামনে সম্মুখ লড়াইয়ে পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হন সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, অধ্যাপক দিলীপ কুমার চৌধুরী, শেখ মোজাফ্ফর আহমদ, আবদুর রব ও ইউনূস। একই দিন তথা ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ সালে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহকে তাঁর প্রতিষ্ঠানের সামনে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা নৃশংসভাবে হত্যা করে। এছাড়াও রাউজান পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের জগৎমল্লাপাড়ার আরও ৩৫ জনকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। যার স্মৃতিফলক হিসেবে শহীদদের নাম ফলক ও স্মৃতিস্তম্ভসহ তিনটি বধ্যভূমি। আজ স্বাধীনতার অর্ধশতবছর পেরিয়ে গেলেও ৭১ এর দোসরের মত এখনো কিছু অপরাধীচক্র অৎ পেতে থাকে রাউজানের মাটিতে।

রাউজান উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌর এলাকা মিলিয়ে রাউজান থানার অধীনে রয়েছে ১টি ফাড়ি, ১টি তদন্ত কেন্দ্র ও ২টি ক্যাম্পসহ মোট ১৭টি বিট অফিস। ফলে স্থানীয় অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও সচেতনতা কারযক্রমে সফলভাবে কাজ করতে সক্ষম হয়েছে রাউজান থানা পুলিশ।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।