Shaan 3

‘শান’ গল্পটির লেখক মোহাম্মাদ গোলাম আজাদ খান, পিপিএম (বার) পুলিশ সুপার, মানিকগঞ্জ জেলা। তিনি তাঁর পেশাগত দায়িত্ব থেকে সত্য নির্ভর ও এ্যাকশন ধর্মী এ সিনেমার গল্পটি লিখেন। অপরাধকে কিভাবে বিনোদনের মাধ্যমে তুলে ধরা যায় । তাঁর উপস্থাপনায় বিষয়টি পাওয়া যায়। মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তরা বিদেশে পাড়ি জমায় পরিবারকে ভালো রাখার জন্য। কিন্তু পরে যায় বিভিন্ন দালাল ও পাচারকারীদের হাতে । শেষ পর্যন্ত একটু সামান্য প্রশান্তির জন্য জীবনটাও শেষ করতে হয়। বাংলাদেশ, ভারত ও থাইল্যান্ডের মতো দেশের সবচেয়ে মানব পাচারের সংখ্যা বেশি । তাছাড়া ঐসকল দেশে মানুষের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন (কিডনি, চোখ, লিভার ও হার্ট ) বিক্রি করা হয়। তাই আজাদ খান তুলে ধরেন সেই সব দৃশ্য নির্ভর এই সিনেমাটি যাতে দর্শকরা বিনোদনের মাধ্যমে সচেতন হতে পারেন। মানব পাচার রোধে সচ্চর হতে পারেন।

শান সিনেমা নিয়ে কিছু কথা

বাংলা চলচ্চিতের অন্যতম সিনেমা শান । যা মানব পাচারের বিরুদ্ধে একমাত্র সিনেমা । যেখানে রয়েছে মানুষ পাচারের ‘দুর্ধর্ষ ফর্মূলা’ ব্যবহার করা হয়েছে। ২০২২ সালে ৩ই মে, মানব পাচার রোধের  ও গল্পকাহিনীতে নির্মিত শান সিনেমাটি মুক্তি পায়। শান সিনেমাটিতে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন সিয়াম আহমেদ ও পূজা চেরি। ছবিটির গল্পকাহিনীতে বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন গল্প লেখক  আজাদ খান। মানিকগঞ্জ জেলার এসপি গোলাম মোহাম্মাদ আজাদ খান পিপিএম (বার) । তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের পুলিশের চাকুরির বিভিন্ন উদ্ধার অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন । তারেই ধারাবাহিকতায় মানব পাচারসহ বিভিন্ন দুর্ধর্ষ অভিযানে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। এক কথায় বলা চলে, আজাদ খানের পেশাগত জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা সম্বলিত। এই শান মুভিটির গল্প রচনা হয়।

Shaan 4

চিত্রনাট্য ও সংলাপের নিরু দারুণ আভাস । একটি সিনেমা সার্থক করতে যে গুণগুলো গল্পের সাথে তুলে ধরা হয় তার সমস্ত কিছুই তুলে ধরেছেন। আর এই নিখুঁদ ভাবে উপস্থাপন চিত্রনাট্য রচনায় ভূমিকা পালন করেন নাজিম উদ দৌলা। সামগ্রিক ভাবে পরিচালনা করেছেন এম এ রহিম। শান মুভিটির প্রযোজনা করেছিলেন কুইক মাল্টিমিডিয়া । সেই সাথে পরিবেশনায় ভূমিকা পালন করেছেন জাজ মাল্টিমিডিয়া।

সময়ের পরিক্রমায় আজকার এই চলচ্চিত্র

একটা সময় সিনেমা হলগুলো দর্শকে পরিপূর্ণ ছিলো । পরিবার-পরিজন মিলে দেখার মতো আবেগ থাকতো সবসময়। ভীর করে দেখতো সবশ্রেণির মানুষ। গ্রাম-বাংলার আবেগ-অনুভূতি মিশ্রিত চিত্রগুলো দেখানো হতো হলে। যুগের সাথে আস্তে আস্তে পরিবর্তন হতে থাকে সিনেমাগুলো । পরিবর্তন হতে থাকে সিনেমার গল্পগুলো। আশি দশকের সিনেমাগুলোতে তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন গল্প দ্বারা নির্মাণ করা হতো। নব্বই শতকে এসে সিনেমার হালচাল কিছুটা পরিবর্তন হয়।

Shaan

আবার পর্যায়ক্রমে দর্শকের আগ্রহ-চাহিদার কথা বিবেচনা করে এসে পরিবর্তন। ঠিক বর্তমান সময়ের চলচ্চিত্রের পরিবর্তন যে হয়েছে। তা একদিনে নয় নিত্য নতুন বিষয়, দর্শকের আগ্রহের উপর নির্ভর করে হয়েছে। একটা সময় পৌরাণিক কাহিনী সম্বলিত সাপের ছবি থাকতো । নাগ-নাগিনীর প্রেম যা দর্শকমহলে ব্যাপক সারা ফেলেছিলো। মানুষের রুচির পরিবর্তনে আসে বেদেদের জীবন ও প্রেম । পরবর্তীতে রাজনীতির প্রেক্ষাপট, তৎকালীন সময়ের শাসক, বেকারত্বের মতো বিষয়গুলো ফুটে উঠতো। নব্বই শতকের পর রাজনীতির পাশাপাশি ‍প্রেম, দৈনন্দিন জীবনের গল্পগুলো ফুটে তুলছে প্রযোজকরা।

 

নব্বইয়ের পরবর্তীর সময়ে সিনেমাগুলোর গল্প

কালের বিবর্তনে পরিবর্তন হতে থাকে মানুষের রুচি । পরবর্তীতে সালমানশাহ মৃত্যুর পর শাকিবখান  প্রেমিকের ভূমিকায় দেখা যায়। তারপর মান্নাকে দেখা যায় রাজনীতিবিদের ভূমিকায় আর বর্তমানে মুভিগুলো হয়েছে আবেগ নির্ভর । সুস্পষ্ট গল্প ছাড়াও তৈরি হয়। আবার অনেকে সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়ে মুভি রচনা করতেছেন। আবার অনেকে দেশের মানুষদের সচেতনামূলক ছবিও তৈরি করছে। এভাবেই চলছে বাংলা সিনেমা হল গুলো ।

Shaan 01

পশ্চিমা সংস্কতির পদচারণায় আস্তে আস্তে মানুষ ডিজিটালাইজেশন হচ্ছে । আর পশ্চিমা সংস্কৃতিকে বরণ করে নিচ্ছে। এবং যুগের সাথে তাল দিতে গিয়ে কুশিলবরাও নিজেকেই সেভাবেই উপস্থাপন করছে। কাজী নজরুল নেই, নেই রবীন্দ্রনাথও তবে তাদের ভূমিকা সর্বদা সবসময় বিরাজমান। অভিনয় শিল্পীরা সুনির্দিষ্ট গল্প, ব্যতিক্রম চলচ্চিত্রের মধ্যে নিজেকে ফুটে তোলতে পারছে না। ফলে চলচ্চিত্র সংস্কৃতি আজ থমকে রয়েছে। মানুষকে বিনোদন দেওয়ার মাধ্যম গুলো আস্তে আস্তে অনলাইনে চলে যাচ্ছে।

 

সিয়াম ও পূজা চেরী জুটি

সিয়াম ও পূজা চেরীর ‘পোড়ামন-২’ এবং ‘দহন’ চলচ্চিত্রের পর । তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যায় ‘শান’ মুভিতে । বিশেষ করে সিয়াম ও পূজা চেরীর জুটির ব্যবসা সফল মুভি ‘পোড়া মন-২’ এবং ‘দহন’ । তৃতীয় জুটি হিসেবে ‘শান’ মুভিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। দীর্ঘ ২২ বছর পর আবারও দেখা যায় এই ছবিতে চম্পা ও অরুণা বিশ্বাসকে । তাদের ভূমিকায় ও অমায়িক চরিত্রের অভিনয়ে চলচ্চিত্র অঙ্গন করেছে। ছবিটির কলাকৌশলীরা অতিনিপুন ভাবে সুন্দর ও মার্জিত ভাবে গল্পে অবস্থান করেছেন। জানা যায়, চম্পা ও অরুণা বিশ্বাস সর্বশেষ ১৯৯৭ সালের ‘প্রেমের স্মৃতি’-তে অভিনয় করেছিলেন। সংগীত শিল্পের ভূমিকায় তরুণ মাইনুল আহসান নোবেলের অভিষেক ঘটে। এর আগে তিনি গানবাংলায় ও ওপার বাংলায় গান গেয়ে দর্শকদের আকর্ষণ করেন।

shaan 5 1

চলচ্চিত্রটির কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দুতে মূলত শানকে নিয়ে উপনীত হয়েছে। প্রথমে মানুষ পাচার থেকে অবহেলা, অযত্ন, এবং দুর্দশা প্রাপ্ত মানবদের অপ্রাকৃতিক ভাবে জীবনযাত্রা। উত্তর-দক্ষিণ এশিয়া, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচার । কালোবাজারীদের আদলে মানুষের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন, কিডনি, হার্টসহ বিভিন্ন অঙ্গ বিক্রি ও পাচারের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। আর সেই অপরাধ নির্মূলের লক্ষ্যে নির্মিত মুভিটি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানো হয়েছে।

 

ব্যতিক্রমধর্মী গল্প নিয়ে আলোচনা

শান চরিত্রে অভিনয় করেছেন সিয়াম আহমেদ । তাঁকে দেখা যায় সদ্য বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উর্ত্তীণ হওয়ার পর বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন। সিয়াম আহমেদ সৎ ও সাহসী পুলিশের চরিত্রে অভিনয় করে মানুষের নজর কাড়েন। অপরাধ নির্মূলে তার নামডাক চারিদিকে ছড়িয়েছিলো।

Shaan 2

সমাজের কিছু প্রভাবশালী রয়েছে । তারা সমাজের নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের লোকদের বিভিন্ন ধরনের প্রলোভন এবং লোভের ফাঁদে ফেলে তাদের বিক্রি করা হতো। আবার অনেককে পাচার করে তাদের বিভিন্ন অঙ্গ বিদেশের হাসপাতালে বিক্রি করে দেওয়া হয়। আর শান সিনেমায় পাচারের  মুলে কাজ করে ‘ভস্কো গ্রুপ’ । মানব পাচার রোধে কাজ করেন সরকারের অবসারপ্রাপ্ত সচিব । কিন্তু কাজ করতে গিয়ে আসে নানান বাধা-বিপত্তি ও হুমকি। কিন্তু এক পর্যায়ে সব কিছু জেনে যায় সিয়াম আহমেদ।

ছবিতে সঙ্গীত শিল্পীর চরিত্রে অভিনয় করেন পূজা চেরী । ভস্কো গ্রুপের কিছু লোক পূজা চেরীকে বিরক্ত ও উঠিয়ে নিতে চাইলে বাধা দেন সিয়াম আহমেদ । এর ফলে সিয়াম আহমেদের সাথে পরিচয় হয় রিয়ার(পূজা) । তাকে নিরাপদে বাসায় পৌঁছে দিতে পরিচয় হয় রিয়ার পরিবারের সাথে । পরবর্তীতে তা ভালোবাসার রূপ নেয়। আস্তে আস্তে প্রেমের মাঝে শান খুঁজতে থাকেন ভস্কোর গ্রুপের লোকদের ।  অবশেষে পেয়ে যান মানব পাচারের মূল হোতাকে।

সিনেমাটির শুটিং স্পট

শান সিনেমাটির শুটিং ২০১৯ সালের ২৬ মে তে শুরু হয়। আর স্পট হিসেবে বা লোকেশন হিসেবে সিলেক করেন ঢাকা উত্তরা। বিভিন্ন ধাপে শুটিং চলে রমজান মাসের রোজার আগে চলচ্চিত্রটির প্রথম ধাপে চিত্র গ্রহণ করা হয়। আবার নারায়ণগঞ্জের জিন্দা পার্কে দ্বিতীয় ধাপে সুটিং করা হয়। পরবর্তীতে ঢাকা অদুরে সাভারে সুটিং অনুষ্ঠিত হয়। তবে খুবেই খারাপ বিষয় হচ্ছে সাভারে চিত্র গ্রহণ করা অবস্থায় নায়ক সিয়াম আহত হন।

shaan 5

আরও পড়তে: শামীম ওসমানের বেড়ে উঠা ও রাজনৈতিক জীবন

অভিনয়ে ছিলেন যাঁরা

শান চরিত্রে অভিনয় করেন সিয়াম আহমেদ। সংগীত শিল্পী রিয়ার ভূমিকায় দেখা যায় পূজী চেরীকে । দীর্ঘ ২২ বছর পর দেখা যায় চম্পাকে যিনি এই ছবিতে সিয়াম আহমেদের মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন। আর একই ভাবে অরুণা বিশ্বাস পূজা চেরীর মায়ের ভূমিকায় থাকেন। ভিলেনের অভিনয়ে মিশা সওদাগর ও তাসকিন রহমানকে দেখা যায়। সবচেয়ে এই মুভির মজার বিষয় হচ্ছে তাসকিন আহমেদকে দেখার জন্য দর্শকদের অনেক আগ্রহ নিয়ে সম্পূর্ণ মুভিটা দেখতে হয়। এছাড়াও নাদের চৌধুরীর, সৈয়দ হাসান ইমাম, আরমান পারভেজ এবং খলিলুর রহমান কাদেরীসহ অনেকে।

Shaan 6

বিপণন ও মুক্তি

‘শান’ ছবির সর্বপ্রথম পোস্টার মুক্তি পায় ২০১৯ সালের ১১ আগষ্ট। পোস্টারটি প্রকাশিত হওয়ার পর দর্শকদের ব্যাপক সাড়া মিলে । ২০২০ সালে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাওয়ার কথা থাকলেও নানান জটিলতায় আটকে যায়। আবার পরবর্তীতে বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে প্রযোজকরা ছবিটির মুক্তি স্থগিত করে দেন। প্রায় দীর্ঘ দুই বছর থাকার পর এই রমজানের রোজার ঈদের পর ৩মে ২০২২ সালে মুক্তি পায় সিনেমাটি। প্রযোজকরা ও পরিচালকরা জানায়, বর্তমানে সব জায়গায় দিন খারাপ যাচ্ছে। টলিউড ও ঢালিউড কোথায় অবস্থা ভালো নেই । তারপরও আমরা আশাবাদী সবার সাড়া পেয়েছি। আর তামিল, হিন্দি সিনেমার অবস্থান বেশ পাকাপোক্ত তারপরও সবার আগ্রহ দেখে বিমোহিত হয়েছি। ব্যবসা বা ব্যবসা নির্ভর চলচ্চিত্র মাত্রই যে খারাপ হবে তা নয়। তবে বাণিজ্য সফল ও বিনোদনের পাশাপাশি তুলে ধরা হয়েছে পুলিশের সাফল্য । দর্শকরা নতুন গল্পও নতুন কিছু খুঁজে পাবে। আর এভাবেই নতুন নতুন গল্পে বাংলা সিনেমার সুদিন ফিরে আসবে।

 

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।