Akkelpur jpg

আক্কেলপুর এর ইতিহাস 

ত্রয়োদশ শতাব্দির শেষ ভাগ। তৎকালিন পুরো রাজশাহী তখন ধর্ম অন্ধতায় ডুবে ছিলো। এমনই সময় আলোর পথ দেখাতে আত্মপ্রকাশ করেন বাংলার প্রথিতযশা সুফী সাধক এবং ধর্ম-প্রচারকদের মধ্যে অন্যতম পীর কামেল হযরত শাহ মখদুম রূপোস রহমতুল্লাহ আলাইহী।

তিনি ( হযরত শাহ মখদুম রূপোস রঃ আঃ ) ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে জয়পুরহাট জেলাধীন তুলশীগঙ্গা নদী হয়ে হাস্তাবসন্তপুর এলাকায় অবস্থান করে স্থানীয় মানুষের মাঝে ইসলাম প্রচারের কাজ করতেন। সেখানকার মানুষের বুদ্ধিমত্তাতে মুগ্ধ হয়ে তাদের নাম দেন আক্কেলমান্দ ! ফারসি ভাষাতে যার অর্থ বুদ্ধিমান এবং পুর একটি প্রত্যয় যার অর্থ নগর। এই আক্কেলমান্দ এবং পুর শব্দের সমন্বয়ে কালক্রমে সে অঞ্চলের নাম হয় আক্কেলপুর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় অবদি এ আক্কেলপুল অঞ্চল তৎকালিন বগুড়া জেলার আদমদীঘি থানার অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং ১৯৭২ সালে আদমদীঘি থানার পাঁচটি ইউনিয়ন যথাক্রমে রুকীন্দীপুর, সোনামুখী, গোপীনাথপুর, তিলকপুর এবং রায়কালী নিয়ে আক্কেলপুর থানা গঠিত হয়। সে সময় আক্কেলপুর রেলগেটের নিকট স্থানীয় ব্যবসায়ী ফজর উদ্দিন আকন্দ সাহেবের ভাড়া বাসায় প্রথমে পুলিশ স্টেশন চালু হয়। পরে ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকরণের মাধ্যমে আক্কেলপুর থানা উপজেলার স্বীকৃতি লাভ করে। সে সময় তুলসীগঙ্গা নদীর পশ্চিম পাড়ের প্রায় ৯ একর জায়গা জুড়ে এর প্রশাসনিক অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়। এর ১৫ বছর পর ১৯৯৯ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারী উপজেলার রুকীন্দীপুর ইউনিয়ন এবং সোনামুখী ইউনিয়ন এর ১৪.৯৮ বর্গ কি.মি অংশ নিয়ে আক্কেলপুর পৌরসভা ঘোষণা করা হয়।

 

বর্তমানে আক্কেলপুর

১৩ ডিসেম্বর ২০২২। আক্কেলপুর উপজেলার আকাশ কুয়াশায় আচ্ছন্ন। শীতের এ সকালেই আক্কেলপুরের পথ ঘাট, বাজার ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এ এলাকার সড়কগুলোতে বড় যানবাহনের চেয়ে ছোট যানের আধিক্য লক্ষ্যনীয়। তন্মধ্যে তিন চাকার রিক্সা-ভ্যানের সংখ্যাই সর্বাধিক।

আক্কেলপুর উপজেলার জনজীবনের বিষদ বর্ণনায় যাওয়ার পূর্বে আমাদের জেনে নেওয়া উচিৎ এ উপজেলার সরকারি অবকাঠামো ও বিশেষ কিছু পরিসংখ্যান সম্পর্কে।

আক্কেলপুর উপজেলার মোট আয়তন ১৩৯.৪৭ বর্গ কি.মি.। জনসংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষ। এর মধ্যে মোট ভোটাধিকার জনবল ৯২,০৯৯ জন। যা জয়পুরহাট-২ নির্বাচনী এলাকার অন্তর্ভূক্ত।

আক্কেলপুর উপজেলার মোট ইউনিয়ন সংখ্যা ৫টি আর পৌর অঞ্চল ১টি। মোট গ্রামের সংখ্যা প্রায় ১৫০টি । অঞ্চলের মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনাবেচার জন্য আক্কেলপুর উপজেলায় রয়েছে মোট ৭টি প্রধান হাট-বাজার। তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় রয়েছে একটি উপজেলা হাসপাতাল এবং ৩৫টি অন্যান্য স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র। রয়েছে মোট তিনটি পশু চিকিৎসালয়, ২টি খাদ্য গুদাম ও ১টি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন।

জয়পুরহাট জেলা সদর থেকে আক্কেলপুর উপজেলার দুরত্ব মাত্র ১৭ কি.মি.

উত্তরবঙ্গের শস্যা ভান্ডার জয়পুরহাট জেলার কৃষিবাণিজ্যে আক্কেলপুরের ভূমিকা সমভাগে বিদ্যমান।

সারাবছর ধান, সরিষা, গম ও আলু উৎপাদন করে স্থানীয় চাহিদা পূরন করার পাশাপাশি রপ্তানি করছে দেশের বিভিন্ন জেলা শহর গুলোতে।

ব্রিটিশ আমল থেকেই রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকায় আক্কেলপুর ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য বিশেষ করে সবজির জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করে। দেশের রাজধানীসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকার সাথে আক্কেলপুরের চমৎকার রেল ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। উপরন্তু বর্ষাকালে নদীপথে যাতায়াত ও মালামাল পরিবহন করা যায়। সম্প্রতি দেশের সব চেয়ে বেশি পোল্ট্রি শিল্প আক্কেলপুর উপজেলায় গড়ে উঠেছে।

পোল্ট্রি শিল্প হচ্ছে সবচেয়ে স্বল্পমূল্যের প্রাণীজ আমিষ যোগানোর মাধ্যম।  যা ব্যাপক কর্মসংস্থান সমৃদ্ধ একটি শিল্প। গ্রামীণ পরিবারের গৃহস্থালি কাজের আয়বর্ধনেরও একটি হাতিয়ার। এই শিল্প যেমন লক্ষ লক্ষ লোকের কর্মের সুযোগ সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে সস্তায় পুষ্টির যোগান দিয়ে দেশে মেধাবী এবং সুস্থ সবল প্রজন্ম সৃষ্টিতে অবদান রাখছে।

তবে এই মুহুর্তে বাজারের প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম উর্ধমুখি হওয়ায় হিমশিম খাচ্ছে পোল্ট্রি ব্যবসায়ীরা। একদিকে মুরগীর খাবারের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছে, অন্যদিকে ক্রেতাদের হায়-হুতাশে হতাশ খোদ পোল্ট্রি খামারীরা। তাদের দাবি উৎপাদন খরচের উপর হিসাব করে মুরগী ও ডিমের দাম নির্ধারণ করলে খামারিরা সঠিক ভাবে ব্যবসা করতে পারবে। নয়তো এ শিল্প ছেড়ে আবারো বেকারত্বের অভিশাপে পরবে দেশের অগণিত নবীন উদ্যোক্তারা। তাছাড়াও এ অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন পেশার সাথে জড়িত রয়েছে।

আক্কেলপুর উপজেলার মানুষ নিজস্ব স্বকীয়তায় প্রতিষ্ঠিত। বর্তমান বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে তারাও এগিয়ে চলছে তাদের মত করে। তবে নগরায়নের মানদন্ডে খুব বেশি এগুতে পারেনি তারা। উচ্চ বিত্ত মানুষের সংখ্যা তেমন নেই। সাধারণত মধ্যবিত্ত পরিবারের বসবাস এখানে বেশি। রয়েছে নিম্নবিত্ত মানুষও। যারা শ্রম বিক্রি করে নিজের জীবন চালায়।

খেটে খাওয়া মানুষের ভিড়ে নগরের পরতে পরতে দেখা মিলবে শতবর্ষী অনেক মানব সন্তানের যারা বয়সের ভারে কুজো হয়ে এখন অবসর জীবনে সময় পার করছে।

আক্কেলপুর উপজেলার ঐতিহ্য বহণ করে আছে প্রায় পাঁচশত বছরের প্রাচীন স্থাপনা গোপীনাথপুর মন্দির

১৩০৪ বঙ্গাব্দের এক ভূমিকম্পে এ মন্দিরটি ভেঙ্গে পড়ে। ১৯২৮ হতে ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বর্তমান মূল মন্দিরটি পুনরায় নির্মাণ করা হয়। এখনও পুরাতন কারুকার্যের কিছু নমুনা মূল ভবনে রয়েছে। মন্দিরটির উচ্চতা ৫০ ফুট। এখানে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় আরতি এবং মধ্যাহ্নে আধামণ চালের অন্নভোগ দেওয়া হয়। প্রতিবছর দোল পূর্ণিমাতে এখানে মেলা বসে এবং দীর্ঘ ৩০ দিন ধরে এ মেলা চলে।

এ উপজেলায় আগত অতিথিরা ইচ্ছে করলেই দেখে আসতে পারেন আক্কেলপুর পৌর সদর হতে মাত্র দেড় কিলোমিটার দুরে তুলসীগঙ্গা নদীর ধারে সোনামুখী ল্যাঙ্গর পীর আব্দুল্লাহ মক্কীর মাজার।

এ মাজারকে ঘিরে আছে অলৌকিক গল্প-কাহিনী। প্রচলিত আছে, গভীর রাতে জঙ্গলের ভেতরে ল্যাঙ্গর পীর স্বর্ণের ঝিক নির্মিত চুলায় নিজের পা দিয়ে রান্না করতেন। এভাবে তিনি কুড়ি বছর সেখানে অবস্থান করেন। তারপর মৃত্যুবরণ করলে সোনামুখীর মানুষ তাকে তৎকালীন ঐ জংগলেই নদীর ধারে দাফন করেন এবং মাজার প্রতিষ্ঠা করেন। পরে নদীর তিন ধার ভেঙে গেলেও মাজারটি সংরক্ষিত থাকে। বর্তমানে মাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসা। তাছাড়া এ উপজেলাতে রয়েছে রণাঙ্গণের স্মৃতি সংরক্ষণে নির্মিত একটি গণকবর ও বধ্যভূমি।

এসব ঐতিহাসিক স্থানগুলো পরিদর্শন শেষ হলে একটু দেখে আসতে পারেন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রখ্যাত পরিচালক, চিত্রনাট্যকার ও প্রযোজক, বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব মনতাজুর রহমান আকবরের পৈত্রিক নিবাস। তিনি উপজেলার বহু উন্নয়নে একজন নিবেদিত প্রাণ।

আক্কেলপুর শিক্ষা দিক্ষায় বেশ এগিয়ে। পরিসংখ্যান মতে আক্কেলপুর উপজেলার বর্তমান শিক্ষার প্রায় ৭০ শতাংশ। মোট নয়টি কলেজসহ বিভিন্ন মাধ্যমের শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে আক্কেলপুর উপজেলায়। রয়েছে একটি মেডিকেল ইনস্টিটিউট।

 

এ নিয়েই গড়ে উঠেছে জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।