Mirzapur jpg

একটি অপরুপ শহর! একটি শৃংখল জনপদ!

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে ৬৮ কি.মি. পশ্চিমে উত্তর বঙ্গের প্রবেশ দার হিসেবে পরিচিত টাঙ্গাইল জেলার তৃতীয় বৃহত্তম উপজেলা, যার নাম মির্জাপুর। শিক্ষা, ব্যবসা ও আইন শৃংখলার মানসহ সকল ক্ষেত্রে সমতালে এগিয়ে চলা একটি উপজেলা হলো মির্জাপুর।

 

 

মির্জাপুর উপজেলার ঐতিহাসিক পটভূমি খুবই গৌরবময় ও প্রাচীণ।

১৯১৩ সালে অঞ্চলের নিরাপত্তার স্বার্থে মির্জাপুরে একটি পুলিশ স্টেশন গঠন করা হয়। ১৯৭১ সালে স্বধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯৮২ সালে মির্জাপুর থানা উপজেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

দেশের প্রাণকেন্দ্র তথা রাজধানী ঢাকা থেকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের নবীনগর মোড় থেকে ডান দিকের রাস্তাটি ধরে কিছু দূর সামনে এগিয়ে গেলেই চন্দ্রা বাজার। এখান থেকে মির্জাপুর সদরের দুরত্ব মাত্র ২০ কি.মি.। অন্যদিকে গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে সোজা পশ্চিম দিকে ছুটে চলা মহাসড়কটিও মিলিত হয়েছে এই চন্দ্রা বাস্ট্যান্ডে। এখান থেকে সড়ক পথের যেকোন ধরনের যানবাহণ ধরে স্বল্প সময়েই পৌছানো যায় মির্জাপুর শহরে।

চার লেনের মহাসড়ক ধরে শহরে প্রবেশ পথে প্রথমেই অতিক্রম করতে হয় মির্জাপুর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের অন্যতম, গোড়াই ইউনিয়ন। কাল পরিক্রমায় গোড়াই ইউনিয়ন শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, খেলাধুলা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার নিজস্ব স্বকীয়তায় আজও সমুজ্জ্বল। এ ইউনিয়নেই রয়েছে দেশের অন্যতম বিদ্যাপিঠ, সুনামধন্য মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ। আড়াই কিলোমিটার পশ্চিমে মির্জাপুর উপজেলা অবস্থিত। মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ বাংলাদেশের তৃতীয় ক্যাডেট কলেজ।

অন্যদিকে মির্জাপুর উপজেলায় রয়েছে বাংলাদেশের বিখ্যাত নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান  ভারতেশ্বরী হোমস। তাছাড়া প্রায় ৬শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে এ উপজেলা জুড়ে। তাই মির্জাপুরকে একটি শিক্ষার নগর বললে কোন ভাবেই ভুল হবে না।

কালের স্বাক্ষী বহনকারী লৌহজং ও বংসাই নদীর  তীরে গড়ে  উঠা মির্জাপুর উপজেলার একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান হলো মহেরা জমিদার বাড়ি। টাঙ্গাইল সদর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে আট একর জায়গা জুড়ে এই মহেড়া জমিদার বাড়ি বিস্তৃত। ১৮৯০ দশকের পূর্বে স্পেনের করডোভা নগরীর আদলে জমিদার বাড়ীটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকবাহিনী মহেড়া জমিদার বাড়ীতে হামলা করে এবং জমিদার বাড়ীর কূলবধূসহ পাঁচজন গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। পরে এ জমিদার বাড়িতে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে জমিদার বাড়ীটি পুলিশ ট্রেনিং স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং ১৯৯২ সালে সকল আঞ্চলিক পুলিশ প্রশিক্ষণ স্কুলকে নবায়িত করে এটিকে পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে রূপান্তরিত করা হয়। এখানে শিক্ষানবিশ কন্সটেবল ছাড়াও নাবিক, বন রক্ষা বাহিনী, চাকুরীরতদের নবায়ন কোর্সের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়ে থাকে।

মহেরা জমিদার বাড়ির সামনে প্রবেশ পথের আগেই রয়েছে ‘বিশাখা সাগর নামে বিশাল এক দীঘি এবং বাড়িতে প্রবেশের জন্য রয়েছে ২টি সুরম্য গেট। এছাড়াও মূল ভবনে পিছনের দিকে পাসরা পুকুর ও রানী পুকুর নামে আরো দুইটি পুকুর রয়েছে । শোভাবর্ধনে রয়েছে সুন্দর ফুলের বাগান। বিশাখা সাগর সংলগ্ন দক্ষিণ পার্শ্বে রয়েছে বিশাল আম্র কানন । জমিদার বাড়ির প্রধান চারটি স্থাপনা হলো চৌধুরী লজ, মহারাজ লজ, আনন্দ লজ, কালীচরণ লজ। এটি টাঙ্গাইল জেলার ঐতিহাসিক স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম স্থাপনা।

তাছাড়া মির্জাপুর উপজেলাতেই রয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম বড় দাতব্য সংস্থা, কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল এর অর্থায়নে পরিচালিত কুমুদিনী হাসপাতাল।

১৯০৩ সালে সাত বছর বয়সী রণদা প্রসাদ সাহা তার মা কুমুদিনী দেবীকে প্রসব-পরবর্তী ধনুষ্টঙ্কার রোগে মারা যেতে দেখেন। মির্জাপুর তখন প্রত্যন্ত গ্রাম। ছিলো না যোগাযোগ ব্যবস্থা, ছিলো না কোন হাসপাতাল বা চিকিৎসা কেন্দ্র। চিকিৎসার অভাবে মাকে হারিয়ে রণদা প্রসাদ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত হয়। পরবর্তীতে বাংলার অন্যতম ধনী ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার পর তিনি তার জীবন দরিদ্র ও অসুস্থদের কল্যাণে এবং নারীর ক্ষমতায়নের জন্য উৎসর্গ করেন।

তারই সাক্ষ্য বহন করে দাড়িয়ে আছে মির্জাপুরের অন্যতম চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান কুমুদীনি হাসপাতাল।

তাছাড়া এ নগরে রয়েছে উপজেলার একমাত্র সরকারি হাসপাতাল মির্জাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সরকারি-বেসরকারি প্রায় শতাধিক চিকিৎসা কেন্দ্রের পাশাপাশি মির্জাপুর উপজেলায় রয়েছে একটি নার্স প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।

মির্জাপুর উপজেলার মোট আয়তন ৩৭৩.৮৮ বর্গকিলোমিটার। এই বিশাল ভূ-খন্ডে বসবাস করে সর্বমোট ৪,২৩,৭০৮ জন। যা মোট ৯৭,৪৩৮টি পরিবারে বিভক্ত রয়েছে। মির্জাপুর উপজেলায় রয়েছে ১টি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়ন। যা সর্বমোট ২৫৭টি গ্রামে বিভক্ত রয়েছে।

মির্জাপুর উপজেলাটি দেশের অন্যান্য উপজেলার ন্যয় কৃষি ভিত্তিক জনপদ হলেও এটি বর্তমানে একটি ব্যবসা বান্ধব উপজেলা। এখানকার, ব্যবসায়ীরা নির্ভয়ে-নির্ভীগ্নে ব্যবসা-বানিজ্য করতে পারে। আইন-শৃঙ্খলার মান ভালো হওয়ায় এখানে চুরি-ডাকাতি, ছিনতাইয়ের ঘটনা খুবই কম। তাই মির্জাপুরের গোড়াই ইউনিয়নে বেশকিছু ভারি শিল্প গড়ে উঠেছে। ছোট বড় হাজার সংখ্যাক শিল্প কারখানার মধ্যে ৪২টি বৃহৎ কারখানার অবস্থান রয়েছে মির্জাপুরে।

অন্যদিকে যোগাযোগ খাতে ব্যপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে মির্জাপুর উপজেলায়। উপজেলার উপর দিয়ে চলে গেছে চার লেনের মহাসড়ক। এ উপজেলা থেকে দেশের সকল প্রান্তে সড়ক পথে অনাআসেই যাতায়াত করা যায়। গোড়াই ফ্লাইওভার, লোহজং সেতুসহ বহু অসখ্যা ব্রীজ-কালভার্ট নির্মিত হয়েছে মির্জাপুরের যোগাযোগ খাতে।

তাছাড়া বাংলাদেশের জনপ্রিয় যোগাযোগ মাধ্যম রেল পথের সাথেও দারুন যোগাযোগ রয়েছে মির্জাপুরের সাথে। এখানে রয়েছে মির্জাপুর রেল স্টেশন নামে একটি স্টেশন। প্রায় ১৭ কি.মি. রেল লাইন চলমান রয়েছে মির্জাপুরের উপর দিয়ে।

 

মির্জাপুর এর শহর বা পল্লী যেদিকেই চোখ যায় এর প্রকৃতি দেখে মুগ্ধ হবে যে কেউ। পুরোটা নগরই ছোট-বড় গাছে ঘেরা। পরিসংখ্যান মতে উপজেলার মোট বনভূমির পরিমাণ ১১,৮৩২ একর।

সবমিলিয়ে মির্জাপুর উপজেলা নিঃসন্দেহে একটি অপরুপ নগর ও একটি শৃংখল জনপদের উদাহরণ।

মির্জাপুর প্রধানত মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ট উপজেলা। তাছাড়া রয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ হিন্দু সম্প্রদায়। তাদের জন্য রয়েছে প্রায় চারশত মসজিদ ও ৮৫টি মন্দির।

তারমধ্যে অন্যতম শ্রী শ্রী রাধা কালাচাঁদ মন্দির। এর কারুকার্য দেখে স্বর্ণ দিয়ে মোড়ানো মনে হওয়ায় এটি ‘স্বর্ণ মন্দির নামেও পরিচিত।

মির্জাপুর উপজেলা উপমহাদেশে বিশেষভাবে পরিচিতি হয়েছে কতিপয় কয়েকজন গুনী ব্যাক্তিদের কারণে। তন্মধ্যে বিশেষ ভাবে উখ্যেখযোগ্য বিখ্যাত সমাজসেবক এবং দানবীর ব্যক্তিত্ব রণদাপ্রসাদ সাহা, এবং ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম ব্যক্তিত্ব ২০০২ সালে একুশে পদক প্রাপ্ত একজন শিক্ষাবিদ ও ভাষা সংগ্রামী প্রতিভা মুৎসুদ্দি।

তাছাড়াও অগনিত গুনি ব্যাক্তির ভিটা এই মির্জাপুর উপজেলা। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে এ মাটির ৩৩ জন সন্তান শহীদ হয়েছিলেন। আর ১৯৭১ এর ১৩ ডিসেম্বর মির্জাপুরকে হানাদার মুক্ত করতে অবদান রেখেছিলেন সর্বমোট ৮৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা। যাদের নাম মির্জাপুর বাসীর অন্তরে চিরকালই স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

 

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।