images 15 22
বছরের পর বছর ধরে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা ও পরামর্শ দান —কথাটা বর্তমান সময়ে শুনতে অবান্তর দেখা গেলেও বাস্তবে তা সত্য। সম্প্রতিতে দেশজুড়ে মনবদরদী এমন এক ডাক্তার সাধারণ মানুষের মন জয় করেছেন। যিনি গত একযুগ ধরে বিনামূল্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করে আসছেন, পাশাপাশি রোগিদের ফ্রিতে দিচ্ছে ফলোআপ। বলছি, সিকেডি এন্ড ইউরোলজি হাসপাতের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক কামরুল ইসলামের কথা। ২০১১ সালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপনা থেকে অবসর গ্রহণ করে ২০১২ সালে ব্যক্তিগত উদ্যােগে গড়ে তুলেন সিকেডি এন্ড ইউরোলজি হাসপাতাল। যেখানে মাত্র দুই লাখ দশ হাজার টাকার বিনিময় কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। প্রতিস্থাপন বাবদ সার্জেনের কোনো পারিশ্রমিক নেন না ডা. কামরুল ইসলাম। কয়েকমাস পরপর কিডনি প্রতিস্থাপক রোগিদের ফলোআপও দিয়ে থাকেন বিনামূল্যে। কামরুল ইসলাম বলেন-
❝আমি হয়ত প্রেমেন্ট নিই না, কিন্তু এতো অনার, এতো এতো ভালোবাসা উচ্ছাস পাচ্ছি; তা কী কোটি দিয়ে কেনা যেত! বরং আমার তো ভয় হয় আমি এর বিনিময় পাবো কীনা।❞
images 19 2
অধ্যাপক কামরুল ইসলাম ও তাঁর দল | ছবি: সংগৃহীত
অধ্যাপক কামরুল ও তার দল এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজারের মতো কিডনি প্রতিস্থাপন করেছে, যার সফলতার হার ৯৬ শতাংশ। গত বছর করোনায় প্রকোপে সরকারি মেডিকেল স্বাস্থ্যসেবা যেখানে অকেজো প্রায় সেখানেও কামরুল ইসলাম ও তার মেডিকেল সহযোগীরা মিলে প্রায় ২৫০টির মতো কিডনি প্রতিস্থাপন করেছে। যার মধ্যে ৩টি ব্যতিত বাকি সব কিডনি প্রতিস্থাপন রোগী সুস্থ জীবনযাপন করছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবা আমিনুল ইসলাম পাকশী ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটে কর্মরত ছিলেন। স্হানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার অপরাধে রাজাকার ও বিহারীরা তাকে হত্যা করে। বাবার মৃত্যুর পর সন্তানের দায়দায়িত্ব মা’য়ের কাঁধে এসে পরে। স্বামীহারা এসএসসি পাশ মা সন্তানদের মানুষ করার জন্য ও নিজের পায়ে দাঁড়াবার জন্য আবার পড়াশোনা শুরু করেন এবং এইচএসসি পাশ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন সমাজবিজ্ঞানে। সেখানে কৃতিত্বের সাথে সমাজবিজ্ঞানে ১ম স্থান অধিকার করে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করে ১৯৮১ সালে লালমাটিয়া মহিলা কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন।
আমিনুল-রহিমা দম্পতির চার ছেলের মেজো ছেলে কামরুল ছিলেন প্রখর মেধাবী। তিনি চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ পাকশী থেকে ১৯৮০ সালে এসএসসিতে মেধা তালিকায় ১৫তম স্থান অর্জন করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয় এবং যথারীতি এইচএসসি পরীক্ষায় ১০ম স্থান অর্জন করে। ১৯৮২ সালে তখনকার আটটি মেডিক্যাল কলেজের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় ১ম স্থান অর্জন করে। সেখান থেকে এমবিবিএস (ডিএমসি) সম্পন্ন করে পরবর্তিতে এফসিপিএস (সার্জারি), এফআরসিএস (এডিন), এমএস (ইউরোলজি) ডিগ্রি অর্জন করেন।
মুক্তিযুদ্ধা বাবার প্রতি সম্মানার্থে ডাক্তারি পেশাকেই নিজের নিজের পেশা হিসেবে বেচে নেন কামরুল ইসলাম। ১৯৯৩ সালে স্বাস্থ্য ক্যাডারে হিসেবে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দেন। প্রথমবারের মতো সফলভাবে কিডনি প্রতিস্থাপনের কাজ করেন ২০০৭ সালে। মজার বিষয় হলো, কিডনি প্রতিস্থাপক সার্জনের দায়িত্ব নেয়ার আগে কামরুল ইসলাম কোরবানির গরু-খাসির কিডনি নিয়ে প্র্যাকটিস করতেন। তিনি বলেন-
❝প্রথম দিকে কিডনি প্রতিস্থাপক সার্জেন হতে চাইনি, যেহেতু সরকারি প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব কাঁধে এসে পরছে তাই এক প্রকার বাধ্য। শুরুতে চারটা মেশিন নিয়ে ডায়ালাইসিস সেটআপ শুরু করি, অল্পদিনে ৩০জনের মতো নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাতো, তাঁদের একজনকে প্রথম ট্রান্সপ্লান্ট করি, ঐটা সফল হওয়ার পর রেফারেন্সে একটার পর একটা আসতে থাকে। এখন তা নিয়মিতই করে যাচ্ছি।❞
সরকারি চাকরিকালে জমানো টাকায় গাড়ি কেনার স্বপ্ন ছিলো, কিন্তু সে টাকায় গাড়ি না কিনে কেনলেন ডায়ালাইসিস মেশিন, এবং বন্ধুদের সহযোগিতা নিয়ে ডাযালাইসিস মেশিনপত্র কেনে সিকেডির কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। বর্তমানে তা দেশের কিডনি প্রতিস্থাপন রোগিদের আস্থা এবং ভালোবাসার জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কামরুল ইসলামের কিছুটা আক্ষেপ রয়েছে দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন সংক্রান্ত যে আইন রয়েছে তা নিয়ে। তার মতে, এ আইনে সার্জনদের প্রোটেকশন কম।রিলেশনশিপ যদি ঠিক না থাকে তাহলে সার্জনদের দায়ী করা হয় অথচ সার্জনের দায়িত্ব অস্ত্রোপচার করা ও রোগীকে সুস্থ করে তোলা। চিকিৎসার জন্য তিনি দায়ী থাকতে পারেন কিন্তু রিলেশনশিপ তার বর্তায় পরে না। তিনি আশাবাদী দেশের বেসরকারিভাবে চিকিৎসা খাতে কিডনি প্রতিস্থাপন যে আশার আলো দেখাচ্ছে তা সূদুর ভবিষ্যতে দেশে সরকারি মেডিকেলেও হবে এবং তা সামগ্রিক দেশের মেডিকেল খাতকে এগিয়ে নিবে।
তার মানবিক কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এ বছর চিকিৎসাশাস্ত্রে পেয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পদক।
error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।